পরেশ দেবনাথ,কেশবপুর,যশোর || মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৯৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গত ২৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ৩১ জানিয়ারী শেষ হলেও এ মধুমেলা রেশ থাকে আরও কয়েক দিন। মেলা উপলক্ষে সাগরদাঁড়িকে সাজানো হয়েছিল বর্ণিল সাজে। কপোতাক্ষ নদ পাড়ের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ মধুভক্ত ও দর্শনার্থীর উপস্থিতিতে মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। কবির জন্মভূমির স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদ, জমিদার বাড়ির আম্রকানন, বুড়ো কাঠবাদাম গাছতলা, বিদায় ঘাট, মধু-পল্লীসহ মেলা প্রাঙ্গণে দর্শনার্থীদের ছিল উপচে পড়া ভীড়। এবারের মধুমেলার ভেতর কৃষি মেলা দৃষ্টি কেড়েছে সকলের।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৯৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে যশোরের সাগরদাঁড়িতে বসেছে সাত দিনব্যাপী মধুমেলা। এটি সারা দেশের মানুষের কাছে আনন্দের উপলক্ষ আর যশোরবাসীর জন্য মহানন্দময় এক উৎসব। প্রথমদিকে এমনটি ছিল না। মধুসূদনের প্রথম জীবনীকার যোগীন্দ্রনাথ বসু ১৮৯০ সালে সাগরদাঁড়িতে এসেছিলেন তথ্য সংগ্রহের জন্য। এখানে এসে তিনি মধুসূদনের জন্মতিথিতে অংশগ্রহণ করেছেন, যা তিনি তাঁর গ্রন্থ ‘মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত’-এর ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন।
ধারণা করি, ১৮৭৩ সালে মধুসূদনের মৃত্যুর পরের বছর ১৮৭৪ সাল থেকেই কবির স্মরণে এলাকাবাসীর উদ্যোগে এখানে প্রথম শুরু হয় মধুসূদন স্মরণসভা। পরে কবির ভ্রাতুষ্পুত্রী কবি মানকুমারী বসুর উদ্যোগে খ্যাতিমান কবি- সাহিত্যিকদের উপস্থিতিতে প্রচলন হয় মধুজয়ন্তীর। ১৯৩৯ সালে সাগরদাঁড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মাইকেল মধুসূদন মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’। এই ট্রাস্টের উদ্যোগে আয়োজিত হয়ে আসছে এ উৎসব। শুরুতে এটাকে বলা হতো ‘মাইকেল উৎসব’। আশির দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা (বিসিক) এটাকে মেলায় রূপান্তর করে। তখন থেকে এই উৎসবের নাম হয় ‘মধুমেলা’। প্রতিবছরের মতো এবারেও সাগরদাঁড়ি সেজেছে নব সাজে। লাখ লাখ মধুভক্তের আগমনে মুখরিত হয়েছে কপোতাক্ষের তীর। মধুসূদন দত্তের জন্মানুষ্ঠান উদযাপনের জন্য এখানে স্থাপিত হয়েছে মধুমঞ্চ। সেই থেকে এই মঞ্চেই সাতদিন ধরে চলছে মহাকবির জীবন ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষক, সুধীজন। মধুমঞ্চে পরিবেশিত হচ্ছে কবির লেখা নাটক, কবিতা থেকে সুরারোপিত গান, কবিতা আবৃত্তিসহ বিভিন্ন পরিবেশনা। এ ছাড়াও পরিবেশিত হচ্ছে বিভিন্ন লোকগান, লাঠিখেলা, নাটক। দুপুর থেকে শুরু হওয়া এই অনুষ্ঠান চলছে রাত বারোটা পর্যন্ত। উন্মুক্ত মঞ্চে বিভিন্ন অপেরা, শৌখিন যাত্রাদলের পরিবেশনায় যাত্রাপালা। চলছে রাতভর। আজ মেলার শেষদিন। এই সাতদিন মধুসূদনের স্মৃতিকে ঘিরে এক অনাবিল সাংস্কৃতিক উৎসবে মেতে ওঠে এলাকার সাংস্কৃতিককর্মী, কবি-লেখকরা। মধুমঞ্চে একদিকে চলছে সাংস্কৃতিক আয়োজন, অন্যদিকে জমজমাট বিনোদনের সমাহার। সাগরদাঁড়ির বিশাল অঙ্গনজুড়ে বসেছে বিভিন্ন পণ্যের দোকান। দূরদূরান্ত থেকে এসেছেন দোকানিরা। বিভিন্ন কুটিরশিল্প, হস্তশিল্প, রকমারি মিষ্টান্ন, রঙিন পান, বেলুন, জুতা, খেলনা, বাঁশ-বেতের পণ্য, লোহার তৈরি দা-বঁটি, তৈষজপত্র, গৃহস্থালি পণ্য, কম্বল, চুড়ি-ফিতা, মেয়েদের সাজগোজের পণ্য, চশমা, ঘড়ি, পোশাকসহ বিচিত্র পণ্যের সমাহার। জমজমাট চা, পিঠা-পুলি, মিনি চাইনিজ, চটপটি, ফুসকার দোকানগুলো। দত্তবাড়ির আঙ্গিনায় মধুসূদন একাডেমির সামনে বইয়ের স্টল। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রিত মধুপল্লী জাদুঘর, যা মূলত মহাকবির বসতভিটা। সেখানে উপচে পড়ছে দর্শনার্থীদের ভিড়। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বসেছে সার্কাস প্যান্ডেল, জাদু প্রদর্শনী, চ্যারিটি শো, খেলনা ট্রেন, মৃত্যুকূপ ও নাগরদোলা। কোনো কোনো প্যান্ডেলে চলছে ঢাকা থেকে আগত চলচ্চিত্র অভিনেতা- অভিনেত্রীদের অভিনয়, নৃত্য। এলাকার কৃষকদের তৈরি সেরা কৃষিজাত পণ্যের সমাহারে লোকারণ্যে ভরে উঠেছে কৃষিমেলা।
মেলা উপলক্ষে এলাকার প্রতিটি ঘরে আসে কুটুম, আত্মীয়স্বজন। মেয়েরা জামাই নিয়ে আসে বাবার বাড়ি। এ মেলায় ঘটকালিও হয়। কেউ কেউ মেলায় এসে খুঁজে পায় প্রিয় পাত্র, প্রিয় পাত্রী। মঙ্গলবার মধুমেলা শেষ হয়ে গেলেও আনন্দময় এ মিলনমেলার জন্য অপেক্ষায় থাকবে এলাকাবাসীসহ মধুপ্রেমীরা।
Copyright © 2022 KhulnarKhobor.com মেইল:khulnarkhobor24@gmail.com।জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা আইনে তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিবন্ধন আবেদিত।স্মারক নম্বর:- ০৫.৪৪.৪৭০০.০২২.১৮.২৪২.২২-১২১।এই নিউজ পোর্টালের কোন লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।