নিউজডেস্ক || ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা গৌরবের এক অনন্য দিন। তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তাল জনসমুদ্রে বজ্র কণ্ঠে হেঁকেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচর-নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে মুক্তির মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত করেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালির স্বাধীনতাসংগ্রাম জনযুদ্ধে পরিণত হয়। ঐতিহাসিক এ ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্ত আর ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা। বিশ্বমানচিত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী বিজয়ী আওয়ামী লীগ তথা বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানামুখী ষড়যন্ত্র লিপ্ত হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল-যে কোনোভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু ১ মার্চ এ অধিবেশন অপ্রত্যাশিতভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবি ঘোষণা করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২ ও ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল পালন করে। এ পটভূমিতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তক্ষুকে উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতায় তার বলিষ্ঠ কণ্ঠে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।
বঙ্গবন্ধু সেদিন শুধু স্বাধীনতার চূড়ান্ত আহ্বান জানিয়েই চুপ থাকেননি, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখাও দিয়েছিলেন। মূলত বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণই ছিল ৯ মাসব্যাপী বাংলার মুক্তিসংগ্রামের ঘোষণা ও মূল ভিত্তি। বেলা ৩টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আসেন। ফাগুনের সূর্য তখনও মাথার উপর। মঞ্চে এসে তিনি জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন। তখন পুরো রেসকোর্স ময়দান লাখ লাখ বাঙালির ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা। তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব-শেখ মুজিব’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে।
প্রায় ১৯ মিনিটের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের পুরো ক্যানভাস তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু বজ্র কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘…তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ কিছু বলবে না। গুলি চালালে আর ভালো হবে না। সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না। বাঙালি মরতে শিখেছে, তাদের কেউ দাবাতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধুর সেদিন জনতাকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন। বলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা মুক্তিকামী মানুষের কাছে লাল-সবুজ পতাকাকে মূর্তমান করে তোলে। বাঙালির ইতিহাসে সূচিত হয় এক গৌরবময় অধ্যায়ের। বঙ্গবন্ধু সেদিন ‘আমি যদি হুমুক দেবার নাও পারি’ বলেও সাড়ে সাত কোটি বাঙালির উদ্দেশে স্বাধীনতার আহ্বান রেখে যান।
সারা দেশ থেকে ছুটে আসা স্বাধীনতাকামী মানুষের ঢলে সেদিন রেসকোর্স ময়দানের চতুর্দিকে জনবিস্ফোরণ ঘটে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে নারী-পুরুষের স্রোতে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। বিকাল ৩টায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল থেকেই মানুষের সমুদ্রে রূপ নেয় রেসকোর্স।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল, উজ্জ্বল প্রেরণাভূমি। কিন্তু ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশে বারবার ইতিহাসের বিকৃতি ঘটেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে প্রকৃত ইতিহাস লুকিয়ে রেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তারা ধূলিসাৎ করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেই ধারাবাহিকতা বন্ধ করা হয়। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিকশিত করার লক্ষ্যে তাদের বঙ্গবন্ধু, ৭ মার্চ ও মহান স্বাধীনতার প্রকৃত সত্য তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্বালাময়ী ভাষণটিকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসাবে ঘোষণা করা হলো।
দিনটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।
বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, ৭ মার্চ, বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় একটি দিন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ কেবল আমাদের নয়, বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্যও প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। পুরো বাঙালি জাতি সেদিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো অবগাহন করেছিলো রাজনীতির মহাকবি বঙ্গবন্ধুর অমর কবিতা। মাত্র ১৮ মিনিটের এই মহাকাব্যে ধ্বনিত হয়েছিল বাঙালি জাতির মুক্তির মহামন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর শাণিত ও প্রদীপ্ত উচ্চারণে কেঁপে উঠেছিল পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের মসনদ। মূলত ৭ মার্চের ভাষণেই নিপীড়িত-নির্যাতিত বাঙালি জাতি খুঁজে পেয়েছিল শোষণমুক্তির কাঙ্খিত পথ। তাই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালির মুক্তির মহাকাব্য।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষ্যে বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাঙালি জাতির জীবনে ৭ মার্চ এক অবিস্মরণীয় দিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে আমাদের ‘স্বাধীনতা নামের এক অমরবাণী শুনান এবং সংগ্রামের মাধ্যমে শৃঙ্খলমুক্তির পথ দেখান।
তিনি বলেন-বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের এই দিনে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান বর্তমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে রচনা করেছিলেন ১৮ মিনিটের এক মহাকাব্য।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মাহেন্দ্রক্ষণে গভীর শ্রদ্ধায় প্রথমেই স্মরণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন জাতীয় চার নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ, দু’লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোন এবং অগণিত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে- যাঁদের মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
Copyright © 2022 KhulnarKhobor.com মেইল:khulnarkhobor24@gmail.com।জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা আইনে তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিবন্ধন আবেদিত।স্মারক নম্বর:- ০৫.৪৪.৪৭০০.০২২.১৮.২৪২.২২-১২১।এই নিউজ পোর্টালের কোন লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।