ইমরুল ইসলাম ইমন,খুলনা প্রতিনিধি || ইউনিমার্ট কঠোর ভাবে পরিবেশবান্ধব নীতিটি মেনে চলছে। সেখানে পাটের ব্যাগের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে তারা শুধু ক্রেতাদের নিজস্ব ব্যাগ আনার অনুমতি দিচ্ছি। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, সেটি পরিবেশবান্ধব উপকরণ থেকে তৈরি হতে হবে। সেক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণরূপে প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহার থেকে সরে এসেছে। ফলে অধিকাংশ গ্রাহককে দোকান থেকে পাটের ব্যাগ কিনতে হচ্ছে।
দেশের অন্যতম বৃহৎ সুপারমার্কেট চেইন স্বপ্ন’র সোনাডাঙ্গা আউটলেট। প্রতিদিনের মতোই বেশ স্বাভাবিকভাবে চলছিল বিক্রয় কার্যক্রম।
স্বপ্ন’র একজন নিয়মিত ও বিশ্বস্ত ক্রেতা প্রায় ৯ হাজার টাকার মুদি জিনিসপত্র কিনেছেন। এক্ষেত্রে তাকে জিনিসপত্র বহনের জন্য একটি পাটের ব্যাগ দেওয়া হয়। যার মূল্য ১৪ টাকা। তখন তিনি এই অতিরিক্ত টাকা দিতে অসম্মতি জানান।
ওই গ্রাহক বলেন,এটি ‘নো প্লাস্টিক’ নীতির আড়ালে গ্রাহকদের কাছ থেকে আরও বেশি অর্থ আদায়ের একটি অ-ন্যায্য কৌশল।’
তার ক্ষোভ অন্য লোকেদের ও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এমন পরিস্থিতি তৈরির ১৫ মিনিটের মধ্যে আউটলেট ম্যানেজার ও বেশ কয়েকজন স্টাফ তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।
শেষ পর্যন্ত ওই গ্রাহক এতটাই বিরক্ত হন যে, তিনি তার পুরো অর্ডারটি বাতিল করেন। তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসানের নেতৃত্বে সাম্প্রতিক এক পদক্ষেপে বাংলাদেশের সমস্ত সুপার স্টোরে পলিথিন ও পলিপ্রোপিলিন জাতীয় শপিং ব্যাগ ব্যবহারের উপর (০১ লা অক্টোবর ২৪) থেকে পুনরায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সুপারশপগুলো এই নীতির অধীনে বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।
যদিও আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোসহ বেশিরভাগ দেশের সুপারস্টোরগুলিতে গ্রাহক নিজেই ব্যাগ নিয়ে আসার রীতি রয়েছে। তবে আমাদের দেশে এখনও এর খুব একটা প্রচলন নেই। এক্ষেত্রে সরকার ঘোষিত নিয়মটি চালু হওয়ার পর থেকে গত ১০ দিনে আমরা দেশব্যাপী মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখেছি।
বাংলাদেশে ২০০২ সালে প্রথম প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু আইনটি শেষ পর্যন্ত অনেকটাই অকার্যকর থেকে যায়। যদিও আইন, প্র -বিধান ইত্যাদি পর্যায়ক্রমে প্রবর্তিত ও সংশোধিত হয়েছে তবে দুর্বল বাস্তবায়ন, অপর্যাপ্ত মনিটরিং ও ব্যাপক অব্যবস্থাপনা এর সাফল্যের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে।
এ ক্ষেত্রে স্বপ্ন’র সিইও সাব্বির নাসির বলেন, “এটি শপিং সিস্টেমের ভবিষ্যৎ এবং আমরা এটি অনেক আগে থেকেই প্রত্যাশা করেছিলাম। গ্রাহকরা এই সিস্টেমের সাথে পরিচিত না হওয়ার কারণে প্রাথমিক পর্যায়টি কিছুটা ইতস্তত করছে। তবে আশা করি ধীরে ধীরে সবাই এর সাথে মানিয়ে নেবে।”
স্বপ্নে আকারের উপর ভিত্তি করে কাগজের ব্যাগ ও পাটের ব্যাগ ৬ টাকা ও ১৪ টাকা দরে বিক্রি হয়। একইসাথে গ্রাহকেরা চাইলে পণ্য নেওয়ার জন্য নিজস্ব ব্যাগ আনতে পারে।
মিনা বাজার আউটলেটের কর্মকর্তা ফারিয়া জন্নাত জানান, তারা গ্রাহকদের নিকট নতুন পরিবেশ-বান্ধব নীতিটি তুলে ধরতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন।
তিনি বলেন,”আমাদের অনেক ক্রেতা এই নীতি সম্পর্কে জানেন না। তাই চেক আউটের সময় আমাদের এটি আলাদাকরে ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে। তাদের বিষয়টি সম্পর্কে জানাতে আলাদাভাবে কষ্ট করতে হচ্ছে। তবে আমরা আশা করি সময়ের সাথে সাথে মানুষ এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। তখন আমাদের প্রতিবার এটি ব্যাখ্যা করতে হবে না।”
রিমা জানান,কিছু গ্রাহক আবার পাটের ব্যাগ কিনতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। এই গ্রাহকদের জন্য তারা অবশিষ্ট কার্টুন কিংবা নেট ব্যাগ দিয়ে থাকেন।
জেসমিন বলেন,”আমরা আমাদের স্টক থেকে বিনামূল্যে কার্টুন দিচ্ছি। কিন্তু মুদি জিনিসপত্র নেওয়ার জন্য এগুলো সবচেয়ে ভালো বিকল্প নয়। যাই হোক, এটি একেবারেই গ্রাহকের পছন্দের ওপর নির্ভর করে।”
এক্ষেত্রে ফ্রিজিং করা আইটেমগুলো অতিরিক্ত সুরক্ষার জন্য বাদামি কাগজের ব্যাগে মোড়ানো হয়। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ গ্রাহকই এই সমস্ত পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না।
সপ্ন’র ক্রেতা মৌসুমি বলেন, “আপনি যদি হিমায়িত আইটেমগুলি কেনার পরে সরাসরি বাড়িতে যান, তবে বাদামি কাগজের ব্যাগগুলি ঠিকঠাকই কাজ করে। কিন্তু একটু বেশি দূরত্বে গেলে কিংবা হিমায়িত পণ্যগুলি সংরক্ষণ করতে আর ও সময়ের প্রয়োজন হলে এই কাগজের ব্যাগগুলি গলে যাওয়া থেকে যথাযথ সুরক্ষা দিতে পারে না।”
স্বপ্ন’র (সুপার সপ) সিইও সাব্বির নাসির চ্যালেঞ্জের বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, “আমরা এই সমস্যার কার্যকর সমাধানের জন্য আরও ভালো বিকল্প খুঁজছি৷”
ব্যাংকার সাহেদ আমিন বলেন,”সুপারস্টোর গুলো এমনিতেই সাধারণ মুদি দোকানের চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল। কারণ এখানে আমাদের অতিরিক্ত ভ্যাট ও ট্যাক্স দিতে হয়। সেক্ষেত্রে আপনি যখন অনেক কিছু কিনছেন, তখন অতিরিক্ত ব্যাগের জন্য অর্থ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ছোটখাটো কিছুর জন্য, যেমন: ১০০ টাকার কেনাকাটার জন্য একটি ব্যাগে ১০ টাকা খরচ করা অতিরিক্ত বলে মনে হয়।”
সোহেল সাহেব তার মেয়ের জন্য জুস কিনতে মীনা বাজারে এসেছিলেন। সেক্ষেত্রে একটি পাটের ব্যাগ কেনার পরিবর্তে তিনি হাতে করেই সেটি নিয়ে যান।
বাজারে অর্গানিক আইটেম গুলির জন্য বাদামি (মোটা) কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। একইসাথে বিনামূল্যে কার্টুন ও নেট ব্যাগ ও দেওয়া হয়। আকারের উপর নির্ভর করে পাটের ব্যাগের দাম ৭ থেকে ১২ টাকা হয়। তবে স্টোর টিতে এখনও কিছু পলিপ্রোপিলিন ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছিল।
এ সম্পর্কে মনা সুপার শপ বিক্রয় কর্মকর্তা তাহসিন তৃষা বলেন,আমাদের কাছে পলিপ্রোপিলিন ব্যাগের একটি আংশ ছিল। আমরা সেগুলি গ্রাহকদের দিচ্ছি,যারা পাটের ব্যাগ কিনতে অসম্মতি জানাচ্ছে। আমাদের এই স্টক ফুরিয়ে গেলে আমরা তাদের আর এগুলো দিব না।”
তাহসিন জানান,তাদের পক্ষ থেকে বেশ উদ্যোগী হয়ে একাধিক টেক্সট বার্তার মাধ্যমে গ্রাহকদের সরকার গৃহীত নতুন নীতি সম্পর্কে জানানো হয়েছে।তাহসিন বলেন,অন্যান্য সাধারণ ক্রেতাদের তুলনায় আমাদের ক্রেতারা নীতিটির সাথে বেশি পরিচিত বলে মনে হচ্ছে।
নগরীর কিছু ছোট,ছোট সুপার শপ ও পরিদর্শন করেছি। সেখানে তারা নতুন নীতি সম্পর্কে অনেকটাই উদাসীন বলে মনে হয়েছে। এমনকি তাদের কিছু বিক্রয়কর্মীর ও এটি সম্পর্কে জানেন না।
নগরীর কিছু সুপার শপ/ মার্টে নেট ও পলিপ্রোপিলিন উভয় ব্যাগই ব্যবহার করা হচ্ছিল। একইসাথে তারা ক্রেতাদের নিজস্ব ব্যাগ নিয়ে আসার সুযোগও রেখেছেন। তবে তারা এখনো পাটের ব্যাগ সরবরাহ বা বিক্রি শুরু করেনি।
অন্যদিকে ইউনিমার্ট,নিরালা মার্ট,স্বপ্ন,ডেইলি বাজার,সেভ এন্ড সেভ,মিনা,মনা,সি এস ডি সুপার শপ/ বাজার, কঠোরভাবে পরিবেশবান্ধব নীতিটি মেনে চলার চেষ্টা করছে। সেখানে পাটের ব্যাগের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে তারা শুধু ক্রেতাদের নিজস্ব ব্যাগ আনার অনুমতি দিচ্ছি। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, সেটি পরিবেশবান্ধব উপকরণ থেকে তৈরি হতে হবে। সেক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণরূপে প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহার থেকে সরে এসেছে। ফলে অধিকাংশ গ্রাহককে দোকান থেকে পাটের ব্যাগ কিনতে হচ্ছে।
কিছু কিছু সুপারশপে পাটের ব্যাগের দাম অন্যান্য সুপারস্টোরের তুলনায় কিছুটা বেশি। দামের এই পার্থক্যটি নিয়মিত ক্রেতাদের মধ্যে কিছু বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু স্টোরটি স্থায়ীভাবে পরিবেশগত নীতিটি কার্যকর করতে বেশ দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে।
নগরীর বেশিরভাগ গ্রাহকই নতুন এই সিস্টেমের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে লড়াই করছেন। এক্ষেত্রে কেউ কেউ ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও প্রকাশ করেছেন।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সামসাদ নাদিম বলেন,বিদেশে কেনাকাটার ক্ষেত্রে আমি সবসময় নিজেই ব্যাগ নিয়ে আসার নীতির প্রশংসা করেছি। এই প্রথা আমাদের দেশে বহুদিন ধরেই চলছিল। আমি খুশি যে, সুপার শপগুলি এটি গ্রহণ করছে। আমাদের লাইফস্টাইল ঘরানার দোকান গুলিতে ও এই নীতির বাস্তবায়ন করা উচিত।”
নগর জুড়ে বিভিন্ন সুপারশপ পরিদর্শন শেষে বলা যায়, পরিবেশবান্ধব ব্যাগের নীতির প্রবর্তনের ক্ষেত্রে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কিছু গ্রাহক এতে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। অন্যরা এটিকে টেকসই বিবেচনায় ইতিবাচক পরিবর্তন হিসাবে দেখছেন। এক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে নতুন সিস্টেমটি পুরো দেশে আরও ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আশা করা হচ্ছে।”
Copyright © 2022 KhulnarKhobor.com মেইল:khulnarkhobor24@gmail.com।জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা আইনে তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিবন্ধন আবেদিত।স্মারক নম্বর:- ০৫.৪৪.৪৭০০.০২২.১৮.২৪২.২২-১২১।এই নিউজ পোর্টালের কোন লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।