অতনু চৌধুরী(রাজু)বাগেরহাট প্রতিনিধি || শীতের মৌসুমে সুন্দরবন সংলগ্ন খালের পানি শুকিয়ে যায়। যে কারণে সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে চলে আসে হরিণের পাল।এ সুযোগ কাজে লাগান হরিণ শিকারিরা। বনের আশপাশের এলাকার শিকারিরা বেপরোয়া হয়ে নিয়মিত হরিণ শিকার করে গোপনে মাংস বিক্রি করেন।
গরু ও খাসির মাংসের তুলনায় হরিণের মাংসের দাম কম হওয়ায় সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় এই বন্য প্রাণীর মাংসের চাহিদা দিন-দিন বেড়ে যাচ্ছে। এ সুযোগে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন চোরা শিকারিরা।বনে শিকার বন্ধ এবং শিকারিদের ধরতে তৎপর রয়েছে বন বিভাগ’সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারপরও থামছে না এই হরিণ নিধন।
বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণ চিত্রা হরিণ। কিন্তু চোরা শিকারিদের হাতে দিনের পর দিন নিধনের ফলে কমছে হরিণ।
গত মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) দুপুর ২টায় বাগেরহাটের মোংলায় হরিণের মাংসসহ ৬ চোরাকারবারিকে আটক করে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন। আটকদের কাছ থেকে ১১ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করা হয়।
এর আগে ৩’জানুয়ারি সকাল ৮টার দিকে কয়রা থানা পুলিশ উপজেলার কালনা বাজারে বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৩৪’কেজি হরিণের মাংস’সহ একজনকে আটক করে। এ সময় হরিণের মাংস বহনকারী একটি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়। আটক ব্যক্তি পাইকগাছা উপজেলার কাশিমনগর গ্রামের মৃত আমিন উদ্দীন মোড়লের ছেলে মোঃ ইকবাল মোড়ল (২৩)।
গত বছরের ৪’নভেম্বর দুপুরে বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার নালা এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি কাঠের নৌকা থেকে ৪৭’কেজি হরিণের মাংস’সহ দুই শিকারিকে আটক করে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন। আটককৃতরা হলেন—মোংলা উপজেলার মোঃ আসাদুল ইসলাম (২৭) ও মোঃ সয়দার শিহাব উদ্দিন (১৯)।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা গ্রামের ছবেদ আলীর ছেলে ইয়াছিনের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তার ফ্রিজ থেকে ৩’কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করে বন বিভাগ।
কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় বৈধ বা অবৈধভাবে বনে ঢুকে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে হরিণ শিকার করেন শিকারিরা। বন ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পেশাদার হরিণ শিকারিদের আছে বিশেষ সিন্ডিকেট এবং তাদের সঙ্গে থাকে এজেন্ট ব্যবসায়ীরা। এসব এজেন্টের মাধ্যমে কখনো অগ্রিম অর্ডার আবার কখনো মাংস এনে তারপর বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করা হয়। কোস্টগার্ড’সহ বন বিভাগের অভিযানে মাঝে মধ্যে কিছু মাংস ধরা পড়লেও অধিকাংশ শিকারি থেকে যাচ্ছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এক শ্রেণির অসাধু বন কর্মকর্তাদের কারণে সুন্দরবনে হরিণ শিকার কমছে না।
বন বিভাগের অভিযানে, গত এক বছরে সাতক্ষীরা রেঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ১’শত কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় উদ্ধার করা হয়েছে ১৫০০টি হরিণ শিকারের ফাঁদ। ১৩টি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২০ জন চোরা শিকারিকে।
সুন্দরবনের আশপাশের গ্রামগুলোতে গরু ও খাসির মাংসের তুলনায় হরিণের মাংস কম দামে পাওয়া যায়। কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের আংটিহারা ও জোড়শিং এলাকা; মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের নয়ানি, হড্ডা, বানিয়াখালী, শেখেরকোনা ও তেঁতুলতলার চর; কয়রা সদর ইউনিয়নের ৪ নম্বর, ৫ নম্বর ও ৬ নম্বর কয়রা; উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের পাথরখালী, কাটকাটা; মহারাজপুর ইউনিয়নের পূর্ব মঠবাড়ি, মঠেরকোনা গ্রাম; মোংলার চিলা, জয়মনি, বৈদ্যমারী, কাটাখাল কুল, বাঁশতলা, কাটাখালী; মোরেলগঞ্জের জিউধরা, গুলিশাখালী, সন্ন্যাসী; শরণখোলার ধানসাগর, তাফালবাড়ী, সোনাতলা, পানিরঘাট, রাজাপুর, রসুলপুর, চালিতাবুনিয়া, দাকোপের ঢাংমারী ও খাজুরা; সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বেশ কিছু গ্রামে গোপনে হরিণের মাংস বিক্রি হয়।এসব এলাকার অনেকে জেলে, বাওয়ালি কিংবা মাওয়ালি বেশে সুন্দরবনে প্রবেশ করে হরিণ শিকার করে লোকালয়ে নিয়ে আসেন। অনেক চোরা শিকারি আবার গোপনে সুন্দরবনে ঢুকে হরিণ শিকার করেন।
সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) জরিপের তথ্য মতে, বর্তমানে সুন্দরবনে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪টি হরিণ রয়েছে। এর আগে ২০০৪ সালে হরিণের সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজারটি। সেই হিসেবে ১৯ বছরের ব্যবধানে সুন্দরবনে হরিণ বেড়েছে ৫৩ হাজার ৬০৪টি।
যেভাবে চলে হরিণ শিকার
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে হরিণের। বিশেষ করে সুন্দরবনের ঘাসবনে এই হরিণ সহজে চোখে পড়ে। কেউ দলে, কেউ আসে একা একা। সোনালি থেকে লালচে বাদামি দেহের ওপর ছোপ ছোপ গোলাকার সাদা ফোঁটা থাকে। যার কারণে এ হরিণের নাম দেওয়া হয়েছে চিত্রা হরিণ। সুন্দরবনে পর্যটন স্পটে এখন হরহামেশাই হরিণ দেখতে পান পর্যটকেরা। মানুষের শব্দ পেলেই ঘন বনে লুকোবার চেষ্টা করে লাজুক এ প্রাণী।
হরিণের নিয়মিত যাতায়াতের পথে ফাঁদ পাতেন শিকারিরা। যাতায়াতের সময় হরিণগুলো আটকে যায়। এক রাতে পেতে আসা হয় ফাঁদ। পরের রাতে গিয়ে আবার দেখা হয়। যেসব এলাকায় হরিণের বিচরণ বেশি সেসব স্থানে নাইলনের জাল পেতে, বিষ মাখিয়ে, স্প্রিং বসানো ফাঁদ পেতে, কলার সঙ্গে বড়শি ঝুলিয়ে, চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে ও তীর অথবা গুলি ছুড়ে হরিণ শিকার করা হয়।
মাছ ধরার পারমিট নিয়ে হরিণ শিকারিরা রাতের আঁধারে গোপনে বনে ঢোকেন। নাইলনের দড়ির এক ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করেন তারা। হরিণের নিয়মিত যাতায়াতের পথে এগুলো পাতা হয়। যাতায়াতের সময় হরিণগুলো আটকে যায়। এক রাতে ফাঁদ পেতে আসা হয়। পরের রাতে গিয়ে আবার ফাঁদ দেখা হয়। অনেক সময় এসব ফাঁদে আটকে হরিণ মারাও যায়। আবার অনেক সময় ফাঁদে পা আটকে জালে জড়িয়ে থাকে।এসব ফাঁদ বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, বঙ্গবন্ধুর চর, কটকা, তালপট্টি, কচিখালি, দুবলা চান্দেরশ্বর, বগি, চরখালি এলাকায়। বিভিন্ন উপলক্ষে চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায় এসব এলাকায়। শিকারিরা বনের ভেতর থেকে হরিণ শিকার করে এনে লোকালয়ে থাকা সহযোগীদের হাতে পৌঁছে দেন। বিভিন্ন জায়গায় হাতবদল হয়ে হরিণ পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো জানান, বন বিভাগ হরিণ শিকারিদের প্রতিনিয়ত ধরছে। এ ছাড়া স্মার্ট পেট্রোলিং টিমও হরিণ শিকারিদের ধরতে কাজ করছে। মূলত শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনের ভেতরে খাল ও নদীতে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় হরিণের বিচরণ বেড়ে যায়। যে কারণে চোরা শিকারিরা এ সময় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এসব শিকারিদের ধরতে বন বিভাগ তৎপর রয়েছে। বন্যপ্রাণী হত্যা ও পাচার রোধে শিকারিদের ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করেছে বন বিভাগ। হরিণের ক্ষেত্রে বনের ভেতরে অপরাধ উদঘাটনের তথ্য দেওয়ায় ২০ হাজার টাকা এবং বনের বাইরে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা দেওয়া আছে।
Copyright © 2022 KhulnarKhobor.com মেইল:khulnarkhobor24@gmail.com।জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা আইনে তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিবন্ধন আবেদিত।স্মারক নম্বর:- ০৫.৪৪.৪৭০০.০২২.১৮.২৪২.২২-১২১।এই নিউজ পোর্টালের কোন লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।