স্টাফ রিপোর্টার || বাগেরহাট সদর থানার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চাপাতলা গ্রামের পূর্বপাড়ায় পুরাতন জনপদ এখন বিলুপ্ত হতে চলেছে। জনবসতি এলাকায় বিশাল কোম্পানীর শব্দ দুষন,কৃষি জমি দখল,পুকুর,কবরখানা দখল আর দুর্গন্ধে ওই এলাকাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। গত ১৮ অক্টোবর চাপাতলা পূর্বপাড়া ইট বিছানো পথ দিয়ে হাটতে গেলেই কোম্পানীর দুর্গন্ধ নাকে আসে।এছাড়া পথ চলতে গিয়ে দেখা যায়,গাছের পাতার ওপর এক ধরণের কালচে আবারণ পড়েছে। ধুলার মত কাঠের গুড়া অঝর ধারায় পড়তে দেখা যায়। এসব অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে এলাকাবাসী নানা ধরনের অসুখে ভূগছে বলে তারা জানান।
ভুক্তভোগী চন্ডিচরণ দাস বলেন,২০১৬ সালে এখানে গড়ে তোলা হয় কোম্পানী। এখানে কাঠের গুড়া দিয়ে তৈরী করা হচ্ছে পারটেক্স বা উডটেক্স। এ কোম্পানীর উৎপাদিত পন্য রপ্তানী করা হয় বিদেশে। এ কোম্পানীর শব্দে রাতে-দিনে কখনই শান্তিতে ঘুমানোর যায় না। দুগর্ন্ধে বাড়িতে টেকা কস্টকর। গাছের পাতায় উড়ে পড়ছে এক ধরণের গুড়ি। যা গাছপালা নস্ট করে ফেলছে। এ কোম্পানী জমি ক্রয়নীতিমালা না মেনে দালালের সহযোগিতায় অল্প অল্প করে বাজার দরে জমি ক্রয় করছে। তাদের বাড়ির চারপাশে জমি বিক্রি হয়ে গেছে। তাদের শুধু এক একর জমি বাকী আছে। তাও কেনার জন্য কোম্পানীর দালাল নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করছে। এখানে ৭/৮টি পরিবারের মধ্যে তারা একটি পরিবার আছেন। বাকীরা সবাই চলে গেছে। তাদের জমি কোম্পানীর মালিক দালালের মাধ্যমে ধীরে ধীরে কিনে নিয়েছে। এখানে চৈত্র্য-বৈশাখ মাসে কোম্পানীর ভিতর থেকে প্রচুর গুড়ি উড়ে আসে। এতে করে এলাকার বাসিন্দারা শ্বাস কস্টে আক্রান্ত হচ্ছেন। গাছপালা মরে যাচ্ছে। রাতে কোম্পানীর শব্দে ঘুমানো কস্টকর হয়ে পড়েছে। এতে করে তারা পরিবারের সবাই নির্ঘুম রাত কাটাতে হচ্ছে বলে জানান আরেক সদস্য শ্যামাপদ দাস।
তিনি জানান, তাদের মূল পেশা পান চাষ করা। তারা পান চাষের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কোম্পানীর কালচে রং যুক্ত গুড়া পানের পাতার ওপর পড়ে গাছ ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে। এ কোম্পানীর মালিক এলাকার বড় বড় চারটি পুকুর ঘিরে ফেলেছে। সময় সুযোগ মত তা ভরাট করে ফেলবে। তবে এলাকার যগিন্দ্রী পুকুর এখনও টিকে আছে। কোম্পানীর দুর্গন্ধে ভাত খাওয়া কস্টকর। যখন কোম্পানীর মেশিন চালু হয় তখন ভুমিকম্পের মত তাদের বাড়ি ঘর কাঁপতে থাকে।
যুথিকা দাস বলেন,এখানে এখন দু’টি পরিবার বসবাস করছে। পুরাতন জনপদ বিলুপ্তের পথে। এখানে শুধু জমি কিনে ক্ষ্যান্ত হচ্ছে তা নয়, দালালরা বাড়ির পাশাপাশি কবরস্থানও কিনে নিয়ে এখানে কোম্পানীর স্থাপনা করছে। তার মধ্যে আনুমানিক দু’কাঠার মত এরিয়ার কেনা মোল্লার কবরস্থান (পারিবারিক) তা কিনে তার ওপর কোম্পানীর স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ভৈরব নদীর ঘাটে শ্মশান ছিল তা দখল করে নিয়েছে। কোম্পানীর কারণে এ পরিবারটি অনেকটা জলাবদ্ধতায় শিকার হয়েছেন। যার জন্য তাদের পানের বরজ পানিতে নস্ট হয়েছে। সীমা রাণী জানান, কোম্পানীর শব্দ দুষণে তারা আজ বদির হতে চলেছেন। জোরে কথা না বললে পরিবারের কেউই কানে শুনতে পান না। কোম্পানীর দালালরা এমনভাবে চাপ দিচ্ছে তাতে জমি না বেঁচে কোন উপায় নেই।
লক্ষী রাণী নামের একজন গৃহিনী জানান,বিকাশ নামের জনৈক দালাল কোম্পানীর হয়ে জমি বাজার দরে ক্রয় করে নেয়। পরে সে কোম্পানীকে দেয়। হরিপদ দাসের স্ত্রী লিলি দাস বলেন, জমিতে হাটুজল হতো। কোম্পানী কিনে নিয়ে তাদের যে টাকা দিয়েছে তাতে তিনি সন্তোষ্ট। তারা বলেন, এখানে সাত পুরুষের বসবাস। ৫/৬টি পরিবার ছাড়া সবাই জমি বিক্রি করছে। এ জন্য পুরাতন জনপদ আর এখানে থাকছে না। পুরাতন লোকালয়ের স্মৃতিবিজড়িত এলাকা ছাড়তে কস্ট হলেও কোম্পানীর দালালের চাপাচাপিতে বাড়ি ও জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি বলে তারা জানান।
পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চ খুলনার আহবায়ক নাগরিক নেতা এড. কুদরত ই খুদা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন,এতবড় কোম্পানী গড়ে উঠেছে অথচ তার কোন সাইন বোর্ড নেই। কোম্পানীর শব্দে আর দুর্গন্ধে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। গত ১৮ অক্টোবর দুপুরের দিকে চাপাতলা পূর্বপাড়া ইট বিছানো পথ দিয়ে হাটতে গেলেই কোম্পানীর দুর্গন্ধ তারসহ একটি প্রতিনিধি দলের সদস্যদের নাকে আসে। এলাকাবাসীদের সাথে কথা বলার সময় দালালদের ঘুরতে দেখা যায়। এরা দরিদ্র এলাকাবাসীকে নানা প্রোলোভন আর ভয়ভীতি দেখিয়ে বাজার দরে জমি কিনে নিচ্ছে। কয়েকটি বড় পুকুর কিনে নিয়েছে। এখন ভরাট করার প্রস্তুতি নিয়েছে। কোম্পানীর ভিতর থেকে বাতাসে উড়ে আসছে এক ধরনের গুড়ি। যা গাছের পাতার ওপর পড়ে কালচে রং ধারণ করছে। এতে করে এলাকার গাছপালা নস্ট হচ্ছে।জনবসতি এলাকায় এ ধরণের কোম্পানী মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। যারা এ কোম্পানীর নিকট জমি বিক্রি করতে রাজি হচ্ছে না তারা খুবই চাপের মুখে রয়েছে বলে এলাকাবাসী তাদের নিকট অভিযোগ করেছে বলে জানান। এসব পুরাতন জনপদে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা আইনগতভাবে ঠিক নয় বলে এই নাগরিক নেতা দাবি করেন। অবিলম্বে এ কোম্পানীর বেআইনী কর্মকান্ড বন্ধের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানান।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে কোন ভাবেই কৃষি জমির প্রকৃতি বদল করা যাবে না। এছাড়া এলাকার পরিবেশ নস্ট করবে। এলাকায় বাসযোগ্য থাকবে না। এটা বে-আইনি এবং আদালতে প্রতিকার যোগ্য। এছাড়া তাই আমরা মনে করি, সরকার ঘোষিত শিল্পাঞ্চল ব্যতিত অপরিকল্পিত ভাবে যত্রতত্র কৃষিজমি নষ্ট করে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এখনই বন্ধ হওয়া উচিৎ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি তদন্ত করে যথাশিঘ্র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা প্রয়োজন।
বাগেরহাট জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান সরকার বলেন, অভিযোগগুলো খুবই গুরুতর। তবে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে এ ধরণের কোন অভিযোগ তার অফিসে দেয়া হয়নি। তাছাড়া ওই কোম্পানী ছাড়পত্র নিয়েছে। তারা যাতে পরিবেশ নস্ট না করে সে বিষয়টি দেখার জন্য একজন কর্মকর্তা দায়িত্বে আছেন। তিনি প্রতিমাসে ওই কোম্পানীর রিপোর্ট দিয়ে থাকেন। সে রিপোর্টে এসব অভিযোগ আসছে না। তারপর বিষয়টি তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখবেন বলে জানান।
Copyright © 2022 KhulnarKhobor.com মেইল:khulnarkhobor24@gmail.com।জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা আইনে তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিবন্ধন আবেদিত।স্মারক নম্বর:- ০৫.৪৪.৪৭০০.০২২.১৮.২৪২.২২-১২১।এই নিউজ পোর্টালের কোন লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।