পরেশ দেবনাথ,কেশবপুর,যশোর ||কেশবপুরে নদী ভরাট ও অপরিকল্পিত মাছের ঘের করার কারণে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি না হলেও হরিহর ও বুড়িভদ্রা নদীর পানিতে পৌর শহরসহ শতাধিক গ্রামের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। নদী পলিতে ভরাটের পাশাপাশি ব্রিজ,কালভার্টের মুখ বন্ধ করে অপরিকল্পিত মাছের ঘের করার কারণেই এ স্থায়ী জলাবদ্ধতা। ‘পানি সরাও মানুষ বাঁচাও’ দাবিতে জনসাধারণ মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ অব্যাহত রেখেছে। শহরের পাইকারি ও খুচরা সবজি বাজার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এ বাজার সরিয়ে শহরের মাইকেল গেট এলাকায় নেয়া হয়েছে। এছাড়াও, পানিতে তলিয়ে গেছে শহরের ধানহাটা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়, কেশবপুর থানা, গমপট্টি, পশুহাটা, কেশবপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজ, মহিলা ফাজিল মাদরাসাসহ অর্ধশতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাঁজিয়া সড়ক, মধুসড়ক, গমপট্টি সড়ক ও গ্রামীণ গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মানুষ পড়েছে মহাবিপাকে। বানভাসি ২০০ পরিবার রাস্তার ওপর পলিথিনের টঙঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যায় আমন খেত, সবজি খেত ও ঘেরবেড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ৭০ কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন কর্তারা গত তিনদিন ধরে জলাবদ্ধ এলাকা পরিদর্শন করলেও এখনও পানি নিষ্কাশনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় বানভাসিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
জানা গেছে,কেশবপুর পৌরসভা ৮টি ইউনিয়নের পানি বুড়িভদ্রা, হরিহর হয়ে শ্রীনদী দিয়ে সাগরে নিষ্কাশন হয়। ২০১৯ সালে প্রায় ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে হরিহর, বুড়িভদ্রা ও আপারভদ্রা নদী খনন করা হলেও তা জনগণের কল্যাণে আসেনি।
খননের দুই বছর যেতে না যেতেই নদীগুলো আবারও পলিতে ভরাট হয়ে যায়। যে কারণে গত চার দিনের ভারি বর্ষণে আপারভদ্রা নদীতে পানি নিষ্কাশন বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হরিহর ও বুড়িভদ্রা নদী উপচে পানি লোকালয়ে ঢুকে পৌরসভাসহ সদর ইউনিয়ন, মজিদপুর, বিদ্যানন্দকাটি, মঙ্গলকোট, পাঁজিয়া, সুফলাকাটি, গৌরিঘোনা ও হাসানপুর ইউনিয়নের ১০৪টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে প্রায় অর্ধলাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এলাকার গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বাসিন্দাদের যাতায়াতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পাইকারি কাঁচাবাজার আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মশিয়ার রহমান বলেন, একমাস ধরে বাজার তলিয়ে রয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে বিকল্প হিসেবে মাইকেল গেটের সামনে বাজার বসানো হয়েছে। তার সমিতির পক্ষে ২৩ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন ধরনের সবজি, আলু বানভাসিদের মাঝে ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। শুক্রবার (০৪ অক্টোবর-২৪) বিকেলে কেশবপুরের পাঁজিয়া ইউনিয়নের পাথরঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৭ বিল বাঁচাও আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক সমাজসেবক বাবুর আলী গোলদার-এর সভাপতিত্বে জলাবদ্ধতার সমস্যা ও সমাধানকল্পে মতবিনিময় সভা করেন।
তিনি বলেন, কেশবপুরে ঘের নীতিমালা উপেক্ষা করে অপরিকল্পিতভাবে সরকারি খাল জবর দখলে নিয়ে সাড়ে চার হাজার মাছের ঘের করা হয়েছে। অধিকাংশ ঘেরই ব্রিজ, কালর্ভাটের মুখ বন্ধ করে করার কারণে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এসব ঘেরে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে ভরাট করলেও প্রশাসন থাকে নির্বিকার। এরপরও আপারভদ্রা নদী সম্পূর্ণ পলিতে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে নদীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। যে কারণে যতসামান্য বৃষ্টিতেই হরিহর ও বুড়িভদ্রা নদী উপচে পানি লোকালয়ে ঢুকে প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা মৎস্য অফিসার সজিব সাহা জানান, ৪৬৫৮ টি মাছের ঘেরের মধ্যে ৩৬৪০ টি ও ৬৬৪০ টি পুকুরের মধ্যে ২৪২০ টি পানিতে তলিয়ে গেছে। এর ফলে ২ হাজার ১৫ মেট্রিকটন সাদা মাছ ও ৮-১০ মেট্রিকটন চিংড়ি মাছ ভেসে যাওয়ায় ৬০ কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হয়েছে। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, চলতি বছর আমনের আবাদ হয় ৯৫০৯ হেক্টর, এরমধ্যে ১৮৩০ হেক্টর জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। সবজি ৬০০ হেক্টর আবাদ হলেও তলিয়ে যায় ২৩৯ হেক্টর, পান, তুলা, মরিচ ও ৬০ হেক্টর জমির তরমুজ খেত পানিতে তলিয়ে ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
উপজেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস জানায়, উপজেলার ৩৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৩০টি মাধ্যমিক ও মাদরাসা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পাঠদান বন্ধ হয়ে গেছে। বানভাসিরা যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের মধ্যকুল, ধোপাপাড়া মোড় ও কেশবপুর সরকারি পাইলট উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর জলাবদ্ধতা নিরসনের দাবিতে কেশবপুর পৌরবাড়ি মালিক সমিতির পক্ষে শহরের ত্রিমোহিনী মোড়ে মানববন্ধন করা হয়েছে। মানববন্ধন থেকে দ্রুত পানি নিষ্কাশনসহ দ্রুত নদী খননের দাবি জানানো হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সুমন সিকদার জানান, গত তিনদিন ধরে তার দপ্তরের উর্ধতন কর্মকর্তারা হরিহর, বুড়িভদ্রা ও আপারভদ্রা নদীসহ বন্যা প্লাবিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। আপাতত নালা করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে অচিরেই এ সমস্যার নিরসন করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাকির হোসেন বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উর্ধতন কর্তাদের সাথে বন্যায় প্লাবিত এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। খুব তাড়াতাড়িই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে। ইতোমধ্যে বানভাসিদের মাঝে সরকারিভাবে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে।
Copyright © 2022 KhulnarKhobor.com মেইল:khulnarkhobor24@gmail.com।জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা আইনে তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিবন্ধন আবেদিত।স্মারক নম্বর:- ০৫.৪৪.৪৭০০.০২২.১৮.২৪২.২২-১২১।এই নিউজ পোর্টালের কোন লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।