মোঃ জসিম উদ্দিন তুহিন,যশোর জেলা প্রতিনিধি।।যশোরে সরকারি সার সরবরাহ ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি সংঘবদ্ধ প্রতারণা চক্রের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সফল অভিযান পরিচালনা করেছে জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। আকিজ রিসোর্স লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান মেসার্স বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেডের পরিচয়ে সরকারি বিএডিসির বিপুল পরিমাণ সার আত্মসাৎ করে কালোবাজারে বিক্রির পরিকল্পনায় জড়িত তিনজনকে গ্রেফতার এবং ২২ লাখ ২৪ হাজার টাক উদ্ধার করা হয়েছে তদন্ত–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ঘটনাটি শুধু একটি আত্মসাতের মামলা নয়—বরং সরকারি কৃষি সরবরাহ ব্যবস্থার নিরাপত্তা, জবাবদিহি এবং অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির ভয়াবহ দুর্বলতাকে উন্মোচিত করেছে।এজাহার সূত্র ও গোয়েন্দা তদন্ত বলছে, ৯ ও ১০ নভেম্বর অভয়নগর এলাকার তিনটি ঘাট—সর্দার জুটমিল ঘাট, মক্কা ঘাট এবং বড়বাড়ি ঘাট—থেকে মোট সাতটি ট্রাকে ৪,৮৪০ বস্তা সার দেশের পাঁচটি জেলার বিএডিসি গোডাউনে পৌঁছানোর কথা ছিল।
বাজারমূল্য প্রায় দুই কোটি ৫২ লাখ টাকার এই সার পরিবহনের দায়িত্বে ছিলেন গ্রেফতার তিনজনসহ তাদের আস্থাভাজন কর্মীরা। কিন্তু নির্ধারিত সময় ১২ নভেম্বর পার হয়ে যাওয়ার পরও কোন ট্রাকই গন্তব্যে পৌঁছেনি। এরপর ১৬ ও ১৭ নভেম্বর আসামি বাবুল দাস এবং পবিত্র কুমার কুণ্ডু প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়ে ই-মেইল পাঠিয়ে দাবি করে—ট্রাকচালকেরা সার চুরি করে পালিয়েছে। তাদের এই দাবি শুধু অসংগতই নয়, বরং ঘটনার দায় এড়ানোর কৌশল বলেই মনে হয়েছে প্রতিষ্ঠানের কাছে, কারণ তারা নিজেরা কোথাও অভিযোগ না দিয়ে নতুন করে আরও ২,৪৪০ বস্তা সার পরিবহনের অনুমতি চাইতে থাকে। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদে তাদের বক্তব্যের অসঙ্গতি ধরা পড়লে সন্দেহ আরও গভীর হয়।২০ নভেম্বর বাদী এমরুল কায়েস অভয়নগর থানায় মামলা দায়ের করলে পুলিশের উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি নড়েচড়ে বসে। যশোরের পুলিশ সুপার রওনক জাহান মামলাটিকে চাঞ্চল্যকর বিবেচনা করে ডিবিকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। বিভিন্ন সূত্র, মোবাইল যোগাযোগ, ঘাটে উপস্থিতির তথ্য এবং অভ্যন্তরীণ নথিপত্র বিশ্লেষণ করে ডিবির অভিযান দল ২৩ নভেম্বর রাতে বঙ্গ ট্রেডার্সের অফিস ঘিরে ফেলে। রাত ৮টা ৩০ মিনিটে গ্রেফতার করা হয় তিনজন—সুমন মজুমদার, বাবুল দাস এবং মো. মাসুম বিল্লাহকে। গ্রেফতারের পর তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে অর্থ লুকিয়ে রাখার তথ্য।
তাদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক ২৪ নভেম্বর নওয়াপাড়া পৌরসভার ওই অফিসেই বাবুল দাসের টেবিলের ড্রয়ার থেকে উদ্ধার করা হয় ২২ লাখ ২৪ হাজার টাকা তদন্তকারীরা মনে করছেন, এই অর্থটি আত্মসাৎ করা সার বিক্রির একটি অংশ এবং এর মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ের লেনদেন সম্পন্ন করা হয়েছিল। বাকি অর্থের বড় অংশ এবং সারগুলো কোথায় গেছে—তা খুঁজে বের করাই এখন তদন্তের মূল লক্ষ্য। ডিবি কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিচ্ছেন, এটি কোনো একক ঘটনা নয়; বরং সার পরিবহন ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় একটি সুসংগঠিত চক্রের অংশ হতে পারে। কারণ ট্রাকচালকদের হঠাৎ একযোগে উধাও হয়ে যাওয়া, পরিবহন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিনিধিদের অস্বাভাবিক আচরণ এবং ঘটনার পরপরই ভুয়া ব্যাখ্যা দিয়ে নতুন চালান নেওয়ার চেষ্টা—এসবই অপরাধের পূর্বপরিকল্পনার দিকটি স্পষ্ট করে।বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারি সার সরবরাহ ব্যবস্থায় দুর্নীতি শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে। বিপুল পরিমাণ সার বাজারে কালোবাজারির মাধ্যমে ছড়িয়ে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকেরা; সারের দাম বাড়তে পারে; এমনকি নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট অঞ্চলে সার ঘাটতিও দেখা দিতে পারে। এই মামলার তদন্ত সঠিকভাবে সম্পন্ন হলে এমন আরও লুকানো চক্র সামনে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ সারের মতো কৌশলগত পণ্য পরিবহনে প্রতিটি ধাপে জবাবদিহির অভাব দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করে এবং সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই চলছিলো চক্রটি।গ্রেফতার তিনজনকে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে এবং তদন্ত চলছে পূর্ণ শক্তিতে।
ডিবি বলছে, আরও কয়েকজন এতে জড়িত থাকতে পারে এবং পুরো চক্র ধরা না পড়া পর্যন্ত অভিযান চলবে। এই ঘটনা দেশের সার পরিবহন ব্যবস্থার নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে এবং ভবিষ্যতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কঠোর নজরদারির প্রয়োজনীয়তাও সামনে নিয়ে এসেছে।
Copyright © 2022 KhulnarKhobor.com মেইল:khulnarkhobor24@gmail.com।জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা আইনে তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিবন্ধন আবেদিত।স্মারক নম্বর:- ০৫.৪৪.৪৭০০.০২২.১৮.২৪২.২২-১২১।এই নিউজ পোর্টালের কোন লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।